ব্রাদার লোসিও বস্তিতে ঘুমান। তিনি মনে করেন, তাদের সঙ্গে থেকেই কিছু করতে হবে। তাদের সঙ্গে না থাকলে, তাদের জীবনযাপন না বুঝলে তাদের জন্য কিছু করবে কী করে। এটাই ভিনদেশি ব্রাদার লোসিওর কাজ করার ধরণ। লোসিও অবশ্য ভিনদেশি কথাটা মানতে নারাজ। তিনি মনে করেন, তিনি আমাদের দেশেরই একজন। বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবেন লোসিও। তাই বাংলাদেশের পথশিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘পথশিশু সেবা সংগঠন’। লিখেছেন আবদুল্লাহ ইফ্ফাত
কাঁধের ঘা-টা এত বেশি যে, কোনোভাবেই সাফ করা যাচ্ছে না। হারুনের কাছে বারবার জানতে চাইলেও সে একই কথা বলছে, সেলাই কাটা হয়েছিল। কিন্তু হিসাবে মিলছে না ব্রাদার লোসিওর। সেলাইয়ের সুতা কেটে ফেলা হলে তো এতদিন ঘা থাকার কথা না। হারুনের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৬ মাস হয়ে গেছে দুর্ঘটনার। অনেক পরে দেখা গেল, ব্রাদার লোসিও যা ভেবেছিলেন তাই। পভিডিন আয়োডিন দিয়ে সাফ করতে গিয়ে দেখা গেল, সেলাই এখনও কাটা হয়নি। ভেতরে সুতা আছে যার কারণে ঘা শুকাচ্ছে না। কিছুক্ষণ সুতা টেনে বের করার চেষ্টা করলেন লোসিও। অনেকক্ষণ টানাটানির ধকল সইতে না পেরে হারুন বেচারা বমিই করে দিল। বমিতে লোসিওর জামা-কাপড় একেবারে মাখামাখি। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ব্রাদার লোসিও পরম মমতায় তুলা ঘষে ঘষে সেই বমি সাফ করলেন। ঘায়ের জায়গাটা ব্যান্ডেজ করলেন। ওষুধ দিয়ে খাওয়ার নিয়ম বলে দিলেন। তারপর হারুনকে একটা ফোন নম্বর দিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘থোমার জন্য দুইটা রাস্তা আছে। থুমি ছাইলে আমাদের শিশু পরিচর্চা কেন্দ্রে ছলে আসিতে পারো। থোমরা রাস্তায় কেন থাকিবে? যদি রাস্তায় থাকিতে না ছাও কালিকে এই নম্বরে ফোন করে ছলে আসিবে। আমি তোমারে সেলাইয়ের সুতা কাটিবার ব্যবস্থা করে দিব।’ বলা শেষ করে মন দিলেন অন্য এক শিশুর দিকে। এভাবে আলাদা আলাদা জায়গা নিয়ে একেকজন একেক রকমের পরিচর্চা দিচ্ছেন পথশিশুদের।
কমলাপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশের গেটের ভেতরের দিকে বসেছে পথশিশু পরিচর্চা কেন্দ্র। দড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট একটা জায়গা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সীমানা প্রাচীরের ভেতরে একপাশে নাহারের নেতৃত্বে আছে খাবার জন্য নির্ধারিত জায়গা, জ্যাকলিনের নেতৃত্বে এক পাশে আছে খেলাধুলার জন্য জায়গা, সাজিদের নেতৃত্বে অন্য পাশে আছে পড়াশোনার জন্য নির্ধারিত জায়গা, জনের নেতৃত্বে অন্য পাশে আছে শিশুদের আঁকাআঁকির জন্য নির্ধারিত জায়গা। একপাশে বসে শিশুদের আদব শেখাচ্ছেন রেজাউল করিম আর পালের গোদা ব্রাদার লোসিও একপাশে বসেছেন ডাক্তারি ডিসপেনসারি নিয়ে। শিশুদের উপস্থিতি অনুযায়ী ৭ জন করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে এক এক স্টপেজে। যার যেখানে ভালো লাগছে উঠে বললে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরের জনের কাছে। এতে করে কোনো বাড়তি প্রেসার পড়ছে না শিশুদের ওপর।
ক্লাসের দিন বিকেলের আগেই গাট্টিপেট্রা নিয়ে হাজির হন ব্রাদার লোসিও। প্রতি বন্ধের দিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বসে লোসি ভাইয়ের পথশিশু পরিচর্চা কেন্দ্র। সারা ঢাকায় এমন অনেক পরিচর্চা কেন্দ্র আছে পথশিশু সেবা সংগঠনের। প্রায় সব পরিচর্চা কেন্দ্রেই নিজে থাকার চেষ্টা করেন লোসিও।
ব্রাদার লোসিও ইতালির নাগরিক। ছিলেন পেশায় ডাক্তার। পরে হয়ে যান গির্জার পাদ্রি। সে কাজ ছেড়ে চলে আসেন বাংলাদেশে পথশিশুদের সেবা করতে। এসে গঠন করেন পথশিশু সেবা কেন্দ্র। নিজের দেশ থেকে মায়ের পেনশনের কিছু টাকা আসে। আর বন্ধু-বান্ধব কিছু পাঠায়। বাংলাদেশের শুভ কামনার্থীরা কিছু দেন। আর সময়ে সময়ে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে চেয়েচিন্তে চলে এই সংগঠন। মণিপুরিপাড়ার রেজাউল করিম তার অব্যবহৃত একটি ঘর দিয়েছেন সংগঠনের ব্যবহারের জন্য। এর সঙ্গে সময়ে সময়ে এসে অংশগ্রহণ করেন বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান, জাদুশিল্পী উলফাত কবিরসহ অনেকে।
প্রতি বছর পথশিশুদের নিয়ে ঈদ পুনর্মিলনীও করা হয়। গত ঈদে নটর ডেম কলেজে হয়ে গেল পথশিশুদের ঈদ পুনর্মিলনী। মিলি রহমান পথশিশুদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন ওষুধ। সাভারের ‘ডার্চ শাহলম ফ্যামিলি দল’ শিশুদের চুল কাটার কাজ করেছে। লতা ও তার দলের কাজ ছিল শিশুদের নতুন কাপড় বণ্টন। লুবনা তার দল নিয়ে পরম মমতায় শিশুদের গোসল করিয়ে নতুন জামাগুলো পরিয়ে দেওয়ার কাজ করেছিলেন। জনি, জন, জ্যাকলিন ও সাজিদ তাদের দল নিয়ে কাগজে আঁকা, কাগজ কেটে ও রঙ দিয়ে ছবি আঁকা শিখিয়েছিলেন । দুপুরের পর ব্রাদার লোসিওর নেতৃত্বে সব পথশিশু খেলাধুলায় অংশ নিয়েছিল। দুপুরে ইতালিয়ান অ্যাম্বাসাডরের পরিচালনায় হয় প্রার্থনা। এ সময় পথশিশুদের জন্য ভাত, সবজি ও মাংস পরিবেশন শেষে শিশুদের নিয়ে আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিকেলে ব্রাদার লোসিওর স্বাগত বক্তব্য দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিশুরা নিজেরা অনুষ্ঠানে নাটক ও গান পরিবেশন করে। সঙ্গে ছিল জাদুশিল্পী উলফাত কবিরের জাদু প্রদর্শনী।
পথশিশুরা ব্রাদার লোসিওর নাম পুরোটা বলতে পারে না। ওরা বলে লুসি ভাই। ঢাকার প্রায় সব পথশিশুই লুসি ভাইকে চেনে। রাস্তায় দেখলেই দৌড়ে এসে বলে তাদের রোগ-শোকের কথা। এভাবে সারা বছর পথশিশুদের নিয়ে মেতে থাকেন লুসি ভাই
ব্রাদার লোসিও বস্তিতে ঘুমান। তিনি মনে করেন, তাদের সঙ্গে থেকেই কিছু করতে হবে। তাদের সঙ্গে না থাকলে, তাদের জীবনযাপন না বুঝলে তাদের জন্য কিছু করবেন কী করে। এটাই ভিনদেশি ব্রাদার লোসিওর কাজ করার ধরন। লোসিও অবশ্য ভিনদেশি কথাটা মানতে নারাজ। তিনি মনে করেন, তিনি আমাদের দেশের একজন। বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবেন লোসিও। তাই বাংলাদেশের পথশিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘পথশিশু সেবা সংগঠন’। বেশ কিছুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে চলে ব্রাদার লোসিওর এই সেবা সংগঠন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আছে পথশিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্চা, বিনোদন ও স্বভাব উন্নয়ন কেন্দ্র। আগারগাঁয়ে আছে ব্রাদার লোসিওর ডেরা। কেউ ‘পথশিশু’ থেকে সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে চাইলে তাকে পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানে। লোসিও এমন একদিনের স্বপ্ন দেখেন, যেদিন কোনো শিশু পথে থাকবে না। পৃথিবীতে জন্মানো প্রত্যেকটা শিশু পৃথিবীর সন্তান। এই পৃথিবীতে আছে সবার সমানভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার। ব্রাদার লোসিও বলেন, সব শিশুর সমান অধিকার নিশ্চিত করার কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।